বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫

বিশ্বের ইহুদি জাতির ৩০০০ বছরের ইতিহাস

সাংবিধানিকভাবে ইহুদি ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় ধর্ম (বাংলাদেশের মত) হলেও, সকল নাগরিকের যার যার ধর্ম পালনের সম্পূর্ণ অধিকার বিদ্যমান। যে কারণে দেশটির জনসংখ্যার ৭৫.৪% ইহুদি, ১৬.৯% আরব মুসলিম, ২.১% আরব খৃষ্টান, ১.৭% দ্রুজ মুসলমান, ৪% নাস্তিক ও অন্যান্য ধর্ম অনুসরণ করে। ইসরাইলি পার্লামেন্ট ভবনেও মুসলিমদের জন্য মসজিদ বিদ্যমান। দেশটিতে সাংসদ, একজন কেবিনেট মন্ত্রী ও সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি পদেও আরব মুসলমানরা আছে। দেশটির জাতীয় ভাষা হিব্রু কিন্তু দাপ্তরিক ভাষা আরবি ও ইংরেজি। রাস্তায় বিলবোর্ড ও সড়ক নির্দেশিকা হিব্রু, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় লিখিত। স্কুলে সকল শিক্ষার্থীর হিব্রু, আরবি ও ইংরিজ ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক। আরব মুসলিমরা প্রধানত ইসরাইলের গালিল, নাজেভ, হাইফা, জেরুজালেম, আক্রি ও রামাল্লায় বসবাস করে। ১,১৫,০০০ দ্রুজদের সবার বসবাস গোলাম মালভূমিতে।
ইহুদি-বিদ্বেষের ধারাবাহিকতা :
ইহুদি-বিদ্বেষ বলতে ইহুদি জাতি, গোষ্ঠী বা ধর্মের প্রতি যেকোনো ধরণের বৈরিতা বা কুসংস্কারকে বোঝানো হয়ে থাকে। এ ধরণের বিদ্বেষের মধ্যে ব্যক্তিগত ঘৃণা থেকে শুরু করে সংঘবদ্ধ জাতি-নিধনও পড়ে। ইংরেজিতে একে বলা হয় এন্টি-সেমিটিজম (Anti-Semitism), যার অর্থ দাঁড়ায় সেমিটিয় সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ। সেমিটিয় একটি বৃহৎ ভাষাভাষী গোষ্ঠী, যার মধ্যে হিব্রুভাষী ছাড়াও আরবি ভাষীরাও অন্তর্ভুক্ত। তথাপি অ্যান্টি-সেমিটিজম ইহুদি-বিদ্বেষ বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়। উনিশ শতকের পূর্বে ইহুদি-বিদ্বেষ ছিল মূলত ধর্ম-ভিত্তিক। খ্রিস্টান ও মুসলমানরা ইহুদি ধর্মের ব্যাপারে তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিকোণের আলোকে এই বিদ্বেষভাব পোষণ করতো। তৎকালীন খ্রিস্টান-শাসিত ইউরোপে বৃহত্তম সংখ্যালঘু ধর্মীয়-গোষ্ঠী হিসেবে ইহুদিরা বিভিন্নসময় ধর্মীয় বিদ্বেষ, নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হত। ধর্মীয় নির্যাতনের মধ্যে ছিল ধর্ম-পালনে বাধা, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ, দেশ থেকে বিতাড়ন ইত্যাদি। শিল্প-বিপ্লবের পর ইহুদিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকে দ্রুত। এ সময় ইউরোপে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটলে, ইহুদিদের প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ দেখা দেয়। জাতিতত্ত্ব সংক্রান্ত অপ-বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা এই বিদ্বেষে ইন্ধন যোগায়। ইহুদিরা অনার্য ও আর্যদের চেয়ে হীন, এমন মতবাদ দেয়া হয় এবং জাতিগতভাবে তাদের বিরুদ্ধে অর্থলিপ্সা, শ্রমবিমুখতা, ধূর্ততা, গোত্রপ্রীতি ও দেশপ্রেমহীনতার অভিযোগ আনা হয়। তৎকালীন ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবী সমাজ ধর্মভিত্তিক বিদ্বেষকে অসংস্কৃত আচরণ মনে করলেও, এই বংশানুগতিক অপতত্ত্বকে 'বৈজ্ঞানিক' তত্ত্ব মনে করে এ ধরণের জাতিগত সংস্কারের যথার্থতা স্বীকার করে নেয়। ১৯৪১, বাবি ইয়ার (Babi Yar) এর গণহত্যা, দুইদিনের ব্যবধানের যেখানে নাৎসী ও স্থানীয় ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রায় ৩৩,০০০ ইহুদিকে গুলি করে হত্যা করে। এই জাতিগত বিদ্বেষ ভয়াবহ চরম আকার ধারণ করে কুড়ি শতকের তৃতীয় দশকে, হিটলারের নাৎসি দল-শাসিত জার্মানিতে। ইহুদি-বিরোধী এই জাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের দায়ও ইহুদিদের উপর চাপিয়ে দিয়ে তারা বিভিন্ন অত্যাচার এবং নিধনমূলক আইন-কানুন প্রণয়ন করে। ১৯৩৯ সালে হিটলার বিভিন্ন দেশ আক্রমণের মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটালে, ইউরোপে ইহুদি নির্যাতন ও নিধন চরমরূপ নেয়। তারা আইন করে ইহুদিদের নিজস্ব নিবাস অধিগ্রহণ করে বন্দী-নিবাসে প্রেরণ করে এবং পর্যায়ক্রমে ইহুদিদের হত্যা করে। তখন প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করা হয়, যা ইতিহাসে 'হলোকস্ট' (Holocaust) নামে পরিচিত।
ইসরাইল-প্যালেস্টাইনের (প্রাক্তন কেনান) আদিবাসীরা কখনো মুসলিম বা খৃষ্টান ছিল না। ইহুদিদের পূর্বপুরুষ ছিল যা্যাবর হিব্রু জাতি, যাদের উদ্ভব মূলত ইরাকের মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে। মূল ইসরাইল অঞ্চলের আদিবাসীদের হটিয়ে দিয়ে তারা সেখানে বাস করা শুরু করে। ঐ ভূখন্ড তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ অনুসারে ঈশ্বর স্বয়ং তাদের প্রদান করেছে, যার বর্ণনা পাওয়া যাবে তাদের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ তৌরাতে এভাবে “মাবুদ ইব্রাহিমকে বললেন, তুমি তোমার নিজের দেশ, আত্মীয় স্বজন ছেড়ে, আমি তোমাকে যে দেশ দেখাবে সে দেশে যাও” (পয়দায়েশ ১১:১২), মূলত বর্তমান ’ইসরাইল’ বা ’কেনান’ সম্পর্কেই তাদের পুস্তকে এ কথা বলা হয়েছে (যেমন বহু মুসলমান বিশ্বাস করে, পুরা পৃথিবীকেই দারুল ইসলাম বানাতে হবে, আল্লাহ তাদের পৃথিবী দিয়ে দিয়েছেন), আসলে এই ভূখন্ড আরো বিস্তৃত ইরাকের দজলা-ফোরাত থেকে মিশরের নীল নদ পর্যন্ত (জেনেসিস--পুরাতন খন্ড), প্যালেস্টাইনীরা আদিবাসীও প্রাচীন ক্যানানাইট, জেবুসাইট, সামারিটান ইত্যাদি জাতির বংশধর। জেনেটিকালি তারা জিওনিস্ট প্রতিবেশী ইহুদিদেরই কাছাকাছি। ষষ্ঠ শতকে ইসলামী শাসন প্রবর্তনের পর হেজাজ অঞ্চলের আরবদের সাথে তাদের রক্তের সংমিশ্রণ ঘটে (যদিও তারা উভয়ই আবার সেমেটিক এবং জেনেটিকালি খুব কাছাকাছি), ইহুদিরা এক সময় আরামাইক (ঈসা বা যিশুর মাতৃভাষা) হিব্রু, এমনকি আরবি ভাষাতেও কথা বলত। ইউরোপীয় ইহুদিদের অনেকেরই ভাষা ছিল তখন ঈদ্দিশ। বর্তমান ইসরাইলী ইহুদিরা তাদের মৃত হিব্রু ভাষাকে জীবিত করেছে নানা বুদ্ধিমত্তায়, যা বিলুপ্ত ঈদ্দিশের আধুনিকায়ন।
এ ব্যাপারে ৩০১৪ সনের ঐতিহাসিকেরা যেভাবে ইহুদী জাতিকে বিশ্লেষণ করবে :
২০১৩ সনের প্রায় ৫০০০ বছর আগে সুমেরু দেশের উর শহরে আব্রাম নামে এক লোক বাস করতেন, যাকে ইহুদীরা তাদের ‘জাতির পিতা’ ও নবী মনে করতো। তিনি আদেশ পেলেন যে, স্রষ্টা তথা ‘যিহোবা’কে মেনে চললে ‘যিহোবা’ তাদের এমন এক দেশ উপহার দিবেন, যেখানে শান্তি-ই শান্তি! আব্রাম বা পরবর্তীতে আব্রাহাম তার জাতি তথা ইহুদীদের কল্যাণের জন্যে যিহোবার সাথে এভাবে এক ‘চুক্তির’ মাধ্যমে যে ‘শান্তির দেশে’ তার জাতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার নাম ছিল ‘কেনান’ (প্যালেস্টাইন-ইসরাইল)।
২০১৪ সনের পূর্ববর্তী প্রাচীন পৃথিবীতে Judaism ছিল ইহুদী ধর্মের প্রতিশব্দ, যারা ছিলো বিশ্বের প্রাচীনতম জাতি ও ধর্মধারী। ‘যিহোবা’কে তারা বিশ্বের একমাত্র স্রষ্টা মনে করতো। যিহোবার অন্য নাম ছিল ‘‘ইয়াহওয়া, যোহেভান, ইলোহিম, শেখিনা, মাকোম’’ ইত্যাদি। এটি আব্রাম কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও মোজেস কর্তৃক প্রবর্তিত বিশ্বের প্রথম কিংবা প্রধানতম একেশ্বরবাদী ধর্ম ছিল। ইহুদীরা পৃথিবীর সর্বত্র বসবাস করতো প্রাচীনকাল থেকেই। যখন যেখানের যে ধর্ম তাই তারা অনুসরণ করতো। ব্যাবিলনে থাকাকালীন ব্যাবিলনের ধর্ম, আবার মিশরে বসবাসের সময় মিশরীয় ফারাওদের ধর্ম মানতো ইহুদীরা। স্রষ্টা তথা ‘যিহোবা’কে মেনে চললে ‘যিহোবা’ তাদের এমন এক দেশ উপহার দিবেন, যেখানে শান্তি-ই শান্তি! আব্রাম বা পরবর্তীতে আব্রাহাম তার জাতি তথা ইহুদীদের কল্যাণের জন্যে যেহোবার সাথে এভাবে এক ‘চুক্তির’ মাধ্যমে যে ‘শান্তির দেশে’ তার জাতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার নাম ছিল ‘কেনান’ (প্যালেস্টাইন), ইহুদীদের প্রথম মন্দিরে নুহের জাহাজ, কল্পিত ‘চিরুবিম’ পশুর মূর্তি ছিল। ‘চিরুবিম’ ছিল আকাশে ভাসমান উড়ন্ত এ্যাঞ্জেল, যাতে উপবেশন করতো ‘যিহোবা’ নিজে। ইহুদীরা তাদের প্রার্থনালয়ে ‘যিহোবা’র কোন মূর্তি রাখতো না কেবল তার পুজো করতো। আবার তারা ‘যিহোবা’ কে ভুলে গিয়ে বেল, মার্ডুক ইত্যাদি দেবতার পুজোও শুরু করে দিয়েছিল বিভিন্ন সময়ে। পূজা থেকে বাদ পড়ার কারণে ‘যিহোবা’ তাই রেগে তাদের শাস্তি দেন কখনো কখনো। পর্যায়ক্রমে তাদের উপর বিশেষ প্রতিনিধি বা নবী ধারাবাহিকভাবে প্রেরণ শুরু করে ইহুদীদেরকে ‘যিহোবা’র পথে আনা ও ধরে রাখার জন্যে। এরূপ অনেক প্রেরিত প্রতিনিধির মধ্যে বিশেষ একজন ছিলেন নবী ‘মোজেস’ যাকে ২০১৪ সনের মুসলমানরা ‘মুসা’ বলতো।

৩টি মন্তব্য:

  1. amr prosono hochha bortomn israel rasto ka obidho rasto bola hoy kano zodi jews dar mother land palestine hoe thake

    উত্তরমুছুন
  2. Bhi apni doya kore Israel somporke ro valo vabe janen ora je ki...khobis...jati

    উত্তরমুছুন
  3. ইহুদি জাতি নিয়ে আপনার তথ্যবহুল লেখাকে স্বাগত জানাই। আশা করি ইহুদি ধর্ম নিয়েও এরপর আরেকটি লেখা পাব।

    উত্তরমুছুন